তিতা কথা - ২
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৮ নভেম্বর, ২০১৪, ০১:৩১:১২ রাত
এর আগে এই ব্লগেই 'তিতা কথা' নামে একটি পোষ্ট দিয়েছিলাম। আজ আরো একটি বিষয় নিয়ে কিছু তিক্ততায় ভরপুর কথা বলতে যাচ্ছি। এই লিখাটি আমার ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে বেশ আগে পোষ্ট করেছিলাম। আজ আবারো ব্লগে পোষ্ট করছি।
বাসায় বসে টিভিতে খবর দেখছিলাম। ৭ নভেম্বর উপলক্ষ্যে দেশীয় রাজনৈতিক ক্যাচাল শুনছিলা্ম। দুই দলের সেই প্রতি বছরের মত এবারো এই দিবসটিকে নিয়ে একে অপরের প্রতি কাঁদা ছোড়াছুড়ি শুনে দেখে বিরক্ত হচ্ছিলাম। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের এই ৭ নভেম্বরের ভূমিকাকে আকাশচুম্বী করে দেখানোর চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত এই দলের নেতারা। অপরদিকে সরকারী দল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে হত্যার দিকটু বড় করে তুলে ধরে জিয়াকে খাটো করায় ব্যস্তভাবে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে।
প্রতিবছরই এরকম হচ্ছে। তবে আমার আজকের লিখার বিষয়টি শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট জিয়াকে নিয়ে।
আমাদের জাতীয়তা 'বাঙ্গালী' থেকে 'বাংলাদেশীতে' পরিবর্তন হওয়াতে এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমার নাগরিক সুবিধায় কোনো হেরফের হয়েছে কিনা? - এই কথাটি ফেসবুকে জানতে চেয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু এবং ছোটভাই Mujib Khan এই বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিল। সেখানে মন্তব্যের এক পর্যায়ে অনুজপ্রতিম Mujib Khan কে কথা দিয়েছিলাম আমাদের বাঙ্গালী জাতিসত্তা থেকে বাংলাদেশীতে কনভার্ট হবার পিছনের কারণ এবং যে মহান ব্যক্তি এই কাজটি করেছিলেন তিনি কোন উদ্দেশ্যে এটি করেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু তথ্যানুসন্ধানী আলোচনা তুলে ধরবো। ছোট ভাই মুজিব খান তার লেখায়-কমেন্টে খুব সুন্দরভাবে এই জাতিসত্তার ট্রান্সফর্মের কারণগুলো তুলে ধরেছে। আমি শুধু দেখাতে চেষ্টা করবো জেনারেল জিয়াউর রহমান তার অভ্যুদয়ের পর থেকে কোন উদ্দেশ্যে আমাদের দেশীয় রাজনীতিতে কিভাবে প্রভাব ফেলেছেন... তার সকল কাজের পেছনের মূল অজানা দিকগুলো সম্পর্কে।
একজন সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে স্যালুট জানাই। আর আমার এই লেখা শুধুমাত্র আলোচনার জন্য, একে কোনো অসৎ রাজনৈতিক নোংরা চোখে না দেখার অনুরোধ করবোঃ-
এক
জেনারেল জিয়ার বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভ্যুদয় অনেকটা ধুমকেতুর মতো। হঠাৎ করেই তিনি মঞ্চে এসেছেন এবং হঠাৎ করেই অপসৃত হয়েছেন।আবির্ভাব-তিরোধানের এই যে আকষ্মিকতা- তার প্রচ্ছায়া তার সমগ্র কর্মকান্ডকেই অনুসরণ করেছে।
মার্চ, ১৯৭১ ইং। চট্টগ্রাম বন্দরে চলছে দারুন উত্তেজনা সোয়াত নামের একটি জাহাজকে কেন্দ্র করে। একদিকে কুলিরা, তাদের সমর্থনে সর্বস্তরের জনগন এবং ইপিআর। তারা মাল খালাস করতে ও দিতে চাইলো না। তাদের প্রতিপক্ষ পাকিস্থানী বাহিনী। অস্তিত্তের জন্য মাল খালাস করা তাদের চাই-ই-চাই।
ধুর্ত অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আনসারী মেজর জিয়াকেই পছন্দ করলেন যোগ্যতম ব্যক্তি হিসাবে। শৃংখলাপরায়ন মেজর জিয়া চললেন দায়িত্ব পালনে। তখন ২৫ মার্চ। মাগরিবের আযান অনেক আগেই হয়ে গেছে। মেজর জিয়া বন্দরের পথে আগ্রাবাদ সড়কে যখন পৌঁছলেন- তখন সামনে অনেক বেরিকেড। একটা সরাচ্ছেন আর জীপ নিয়ে এগোচ্ছেন। একটু একটু করে তিনি ঢুকে পড়লেন একেবারে ইপিআর এর রকেট লাঞ্চারের আওতায়- ট্রিগার টিপলেই খতম। সেনাবাহিনীরই একজন অফিসার ক্যাপ্টেন মোসলেম উদ্দিন জানতেন- কে আছেন ঐ জীপে। নিরস্ত করলেন তিনি। এবং এরপর নিজেই গিয়ে ফিরিয়ে নিলেন তাঁকে। কিন্ত ক্যান্টনমেন্টে আর ফেরা হল না তার। সেখানে পাকিস্থানীরা বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে।
এই ঘটনারই ধারাবাহিকতায় পরদিন ২৬ মার্চ তার জীবনে এলো আর এক সুবর্ণ সুযোগ।একজন সামরিক অফিসারকে রেডিওতে ঘোষনা দিতে হবে। ইপিআর এর লোকেরা তখন শহরে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত। বাইরে আসার সুযোগ নেই। কালুর ঘাটের কাছেই ছিলেন মেজর জিয়া হাউড-আউটে। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল বেতার কেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন তিনি।
এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্পুর্ণ আকস্মিকভাবে তার আবির্ভাব- শুধুমাত্র সঠিক সময়ে সঠিক যায়গায় থাকার কারনে। আজ যারা এই ঘোষণা পাঠকে কিংবা ঘোষণা প্রদানকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার একমাত্র টার্ণিং পয়েন্ট বলতে চায়, তারা ১০০% মুর্খ বলে মনে করছি। তার এই ঘোষনাকে আমি খাটো করে দেখছি না। তবে যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের দ্বারা ১৯৪৮ থেকে এদেশের বাঙ্গালীরা নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র্য আবাসভূমির স্বপ্ন দেখে নিজেদেরকে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছিল, সেখানে মেজর জিয়ার ভুমিকা কতটুকু আর কোন যায়গাটায় তিনি ছিলেন? কেউ আমাকে দেখাক? ১৯৪৮-১৯৫২-১৯৫৪-১৯৫৮-১৯৬২-১৯৬৯-১৯৭০ হয়ে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত একটি বাংলাদেশকে জাগ্রত করায় মেজর জিয়া কোন প্রভাব বিস্তার করেন বা তিনি কি নেতৃত্ত দিয়েছিলেন?? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই ধাপগুলোর প্রতিটিতেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। আর যে কোনো দেশের স্বাধীনতা অচেনা অজানা কোন ব্যক্তির একদিনের ঘোষণায় হয়নি-হয়না এবং কখনো হবেও না। এটা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাবো।
আর সেই সময়ের মেজর জিয়া একজন সেক্টর কমান্ডার হিসাবে অন্য আরো সেক্টর কমান্ডারের মতই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। যারা মুজিবনগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারে অধীনে ছিলেন।
সুতরাং জিয়ার আবির্ভাব ছিল সম্পুর্ণ কাকতালীয় ও আকস্মিক তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
দুই
১৯৭৫’র নভেম্বর। খালেদ মোশাররফ চক্র ক্ষমতা দখল করল ৩ নভেম্বর। তার মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফ এমপি মিছিল করে ছুটলেন ৩২ নম্বর রোডে। সিপাহী জনতার চোখ খুলে গেলো। ৭ নভেম্বর রাতে জোয়ান-জনতার স্বতঃস্ফুর্ত অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফের পতন হল, অতি প্রত্যুষে বেতার তরঙ্গে ভেসে এল সেই কন্ঠ-‘আমি জিয়া বলছি। আমি অত্যন্ত অস্থায়ীভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহন করেছি।‘ সকালে জানা গেল, স্বঘোষিত সামরিক প্রধান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অপসারণ করা হয়েছে, মেজর জেনারেল জিয়া সেনা প্রধানের দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন। বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকছেন।একই আকস্মিকতার ছোঁয়া এবারও।
ক’মাস পরে বিচারপতি সায়েম পদত্যাগ করলেন, লেঃ জেনারেল জিয়া হলেন রাষ্ট্রপতি এবং এবারও আকস্মিকভাবেই।
ক’দিন পরেই ঘোষনা এল- হ্যা/না ভোট হবে ’৭৭ এর ৩০ মে আর এ উপলক্ষ্যেই তিনি ঘোষণা করলেন ১৯-দফা কর্মসুচী। নির্ধারিত তারিখে গণভোট হল। ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৮ জন ভোটারের মধ্যে বৈধ ভোট পড়ল ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৭৯ হাজার ৭৬৮ টি। তার পক্ষে ভোট পড়ল ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭০ টি (৯৮.৮৮%) এবং ‘না’ ভোট পড়ল ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৮ টি (১.১২%)। [সুত্রঃ বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন]
তিন
’৭৮ সালের ১ মে গঠিত হল জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট- ৩ জুন (’৭৮) অনুষ্ঠেয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে। ৬টি রাজনৈতিক দল এই ফ্রন্টে যোগ দিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া এর কোনো দলেরই সদস্য ছিলেন না। তাকেই করা হল ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী। ’৭৮ সালের ২৫ মে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নির্বাচনী ঘোষণাপত্র ও কর্মসুচী প্রকাশ করা হয়। তবে সেখানে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯-দফা সম্পর্কে একটি বাক্যে সামান্য উল্লেখ ব্যতীত আর কোনো উচ্চবাচ্য ছিল না। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ১৩-দফায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯-দফা সম্পর্কে উচ্চবাচ্য না করার অন্য স্বাভাবিক অর্থ হচ্ছে- জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ১৯-দফাকে সেইভাবে গ্রহন বা অনুমোদন করেনি। পরবর্তীতে ৩ জুনের নির্বাচনে ফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তার ১৯-দফাকে ওভারলুক করেই।
জনগন দ্বারা বিপূলভাবে অনুমোদিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ‘রাষ্ট্রীয় ও শাসনতান্ত্রিক নীতি’ শিরোনামভুক্ত ৪ নম্বর দফার (ক) অনুচ্ছেদটি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একটি অতিশয় গুরুত্বপুর্ণ বিষয় যার নির্গলিতার্থ হচ্ছেঃ সরকার পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি পরবর্তী নির্বাচিত পার্লামেন্ট নির্ধারণ করবে।
আজ বলা যায়, প্রেসিডেন্ট জিয়া যদি আর সব কিছু বাদ দিয়ে এই একটি মাত্র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সৎ থাকতেন, নির্বাচনী গণরায়কে বানচাল না করতেন, তাহলে হয়ত বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হত। হয়ত তার এই অকাল ও মর্মান্তিক এবং অস্বাভাবিক পরিণতি হত না। শুধু তাই নয়, তার আমলে বার বার কুড়িবার সামরিক অভ্যুত্থানের অভিযোগে যে শত শত সোনার সন্তানকে ফাঁসিতে ঝুলান হয়েছে, অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছে, অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়েছে – হয়ত সেগুলোও ঘটতনা।হয়ত বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘিরে আজকেও যে জটিলতার জের চলছে, তা থাকতনা।
ক্ষমতার কেন্দ্রে যাবার জন্য জিয়া মরিয়া ছিলেন। তিনি এজন্য যে কোন কিছু করতে পিছপা হতেন না। তিনি নিজে ’৭৭ এ ১৯-দফা দিয়েছেন, ’৭৮ –এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নিজেই আবার নিজের ১৯-দফা বাদ দিয়ে ফ্রন্টের ১৩-দফার উপর সওয়ার হয়েছেন এবং নির্বাচনে জিতে আবার সেই ১৩-দফার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন- জাতীয়তাবাদী দলের ৩১-দফা গ্রহনের মাধ্যমে। এই ওয়াদা ভঙ্গের চূড়ান্তকরণ হয় ’৭৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে ( এ ক্ষেত্রেও পুর্ববত আকস্মিকতা লক্ষণীয়), এক সমাবেশে তিনি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের বিলুপ্তি ঘোষণা করে দিলেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কেবল যে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে গলা টিপে হত্যা করা হল তা-ই নয়, কিংবা শুধু এও নয় যে, প্রেসিডেন্ট জিয়া তার নির্বাচনী ওয়াদাকে পদদলিত করলেন। উপরন্ত এই ঘোষণার বেদীমূলে গণতন্ত্রেরও কবর রচিত হল। কেননা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট প্রেসিডেন্ট জিয়ার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলনা। এই ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল ৬টি দলের মধ্যে। ৬টি দলের ১২ জন সদস্য এর ষ্টিয়ারিং কমিটিতে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া ফ্রন্টের শরীক কোন দলের সদস্যই ছিলেন না। ফ্রন্ট তাঁকে জাতীয় ঐক্যের খাতিরে দল বহির্ভুত লোক হিসাবে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছিল মাত্র। সুতরাং ফ্রন্টের অস্তিত্ব – অনস্তিত্বের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহনে তার কোনো অধিকারই ছিল না, চেয়ারম্যান হিসেবে দেয় ক্ষমতা বাদে। কিন্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সামান্যতম পরিচয়কেও ধুয়ে-মুছে তিনি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন-রক্ষক হয়ে সাজলেন ভক্ষক। এবং এ ব্যাপারে ফ্রন্টের ষ্টিয়ারিং কমিটিতে আলোচনা করা পর্যন্ত প্রয়োজন বোধ করলেন না বিলুপ্তি ঘোষণার আগে।
চার
আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে যাচ্ছি। মূল আলোচনা ছিল আমাদের জাতীয়তা বাঙ্গালী থেকে কেন বাংলাদেশী করা হল? এটা কি এতোটাই জরূরী ছিল? তার আগে আরো একবার পিছু ফিরে কিছু জিনিস দেখে আসি। এই জাতীয়তা পরিবর্তন আসলে ছিল এক ধরণের চমক- জনগনের সামনে মুলো ঝুলিয়ে সামনের দিকে আগাতে বাধ্য করা।
হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে সংবাদ বেরোলঃ ’আজ প্রেসিডেন্ট জিয়া বুড়িগঙ্গা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।‘ পরদিন কাগজে বের হল আরও বড় এবং সচিত্র খবরঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার বুড়িগঙ্গা সেতুর ভিত্তি স্থাপন (৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮১)। আর একদিন কাগজে ছাপা হলঃ আজ প্রেসিডেন্ট জিয়া আশুগঞ্জ সার কারখানা উদ্বোধন করবেন। হেলিকপ্টারে আশুগঞ্জ গমন ও সার কারখানা উদ্বোধনের বিস্তারিত প্রতিবেদনও পরের দিনের কাগজে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ;বুড়িগঙ্গা সেতুর’ কাগুজে অস্তিত্বও তখন ছিল না। আর আশুগঞ্জ সার কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছিল উদ্বোধনের বহু পরে-জিয়া তখন বেঁচে নেই।
ঐ দুটো ঘটনার পেছনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার একটি প্রবণতাই কাজ করেছে- চমক সৃষ্টি। এই চমকই প্রেসিডেন্ট জিয়াকে যেন আগাগোড়া তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অভ্যুদয় থেকে তিরোধান পর্যন্ত পুরো সময়টাই এমনি চমৎকার সব ‘চমকে’ আচ্ছাদিত। তার জনপ্রিয়তা ছিল। ফলে, এসব চমকে দেশবাসী চমতকৃত হয়েছে, আশান্বিত হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই, রাজনীতি এমন একটি ভুবন-যেখানে চমক দিয়ে চিরস্থায়ীভাবে পার পাওয়া যায়না। তার বেলায় এই বিরুপ বাস্তবতা যেন একটু বেশীই তাড়াতাড়ি ধরা দিয়েছে।
অনুজ Mujib Khan ওর লেখায়, বাংলা ভাষাভাষী হবার যে অজুহাতে আমাদের জাতীয়তা পরিবর্তন করা হয়েছে – সেটির অন্তঃসারশুন্যতা কে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তাই সেদিকে আর গেলাম না। তবে ভারতের একটি প্রদেশের ভাষাকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে জেনারেল জিয়া শুধুমাত্র ভারত বিরোধীতাকে জনগনের মাঝে উস্কে দিয়ে চমক সৃষ্টি করাতেই এই বাংলাদেশী জাতীয়তার প্রবর্তন করেন। কিন্তু তিনি তার শাসনামলে ভারতের সাথে কি করেছেন একটু আলোচনা করি। জিয়া যেখানে ’৭৬-৭৭ সালে দুর্জয় সাহস নিয়ে বিএসএফ ও ভারতের অন্যান্য বাহিনী সমর্থিত এবং কাদের সিদ্দিকীর নামে পরিচালিত সীমান্ত হামলা মোকাবেলা করেছেন, হামলাকারীদের মূলোৎপাটন করেছেন- তিনিই সরাসরি পাইপযোগে ভারতে গ্যাস পাচারে উদ্যত; তাঁর জালানী মন্ত্রী বলতে সাহস পাচ্ছেন-‘ ভারতে সরাসরি পাইপযোগে গ্যাস সরবরাহ করা আমাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রয়োজন।‘ পরবর্তীতে জনগনকে আন্দোলন করে তাঁকে তা থেকে ফেরাতে হয়েছে। আসলে জাতীয় ঐক্যের পিঠে কুঠারাঘাত করে তিনি যেখানে দাড়িয়েছিলেন সেখানে পায়ের তলার মাটি হয়ে পড়েছিল নড়বড়ে। সুতরাং নতজানু হয়ে বাইরের শক্তিকে তুষ্ট করে ক্ষমতায় থাকা-এই ছিল গ্যাস পাচার প্রচেষ্টার নেপথ্য দর্শন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সকল দফা ও পরিবর্তন – ঐ ‘বুড়িগঙ্গা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের’ মতই এগুলো একগুচ্ছ চমক ছাড়া আর কিছু নয়। এক এক করে তাঁর দফাগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায়-অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে এখানে কিছু লোভনীয় আশা দেশবাসীর সামনে ঝোলানো হয়েছে। তবে সে ‘আশা’ পুরণের সম্ভাবনাকে কোন ‘টাইম-ফ্রেমে’ বাধার সুযোগ নেই। সেটা ৫, ১০ ,২০ ,৫০ চাই কি ১০০ বছরে বাস্তবায়িত হতেও যেন বাঁধা নেই। উদাহরণস্বরূপ ১১ নম্বর দফার কথা বলা যায়। এ দফায় বলা হয়েচে- সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং যুব সমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা হবে। নারী সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে একটাই অগ্রগতি হয়েছে। ‘খাল কাটা বিপ্লবে’ তিনি নারী সমাবেশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু শুধু খাল কাটলেই নারী সমাজ মর্যাদা পায় কি-না সেটা ভেবে দেখার বিষয়। আর যুব সমাজ? এদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য করা হয়েছিল যুব কমপ্লেক্স। আর যুব কমপ্লেক্সের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল গ্রামের হাট বাজার। হাট বাজারে তোলা আদায়কে কেন্দ্র করে গ্রামীণ কৃষক শোষণের এই ‘বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচী’ একটা ‘সুফলই’ দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে-গুন্ডামি ও সন্ত্রাস শহর থেকে গ্রামেও সম্প্রসারিত হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠনের পরে প্রেসিডেন্ট জিয়া দম্ভ করে বলেছিলেনঃ ‘I will make politics difficult.’ সম্ভবতঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার এটাই একমাত্র বক্তব্য-যেখানে কথা ও কাজের সংগতি খুজে পাওয়া যায়। আসলেই তিনি রাজনীতিকে কঠিন করে দিয়েছেন। রাজনৈতিক ইন্সটিটিউশন ভেঙ্গে চুরমার করেছেন। আর আমাদের জাতীয়তার পরিবর্তন ও ছিল এমনই একটা ভাঙ্গাচুরা যা দ্বারা দেশের জনগনের কোনো লাভ ই হয়নি।।
.
বিষয়: রাজনীতি
১২১৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রথম মন্তব্যকারিনী হিসাবে রইলো শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 7238
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
শুধু মাইনাস লিখলে মন্তব্যটা কি আরো সুন্দর হত না?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনস্বীকার্য্য ভাবে মুজিব-জিয়া কে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে,তাদের সম্পর্কে কোন কথা-মুল্যায়ণ ব্যক্তির ধ্বংশ ডেকে আনে!
স্বীয় পক্ষের লোকেরা তাদের কে ফেরেশ্তার উর্ধ্বে মনে করে আবার বিরোধী পক্ষ শয়তানেরও অধম মনে করে!
লেখাটা পড়লাম।মুল্যায়ণে ভিন্নতা থাকলেও যৌক্তিক সুন্দর উপস্হাপনায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি তথ্যবহুল আলোচনায়!!
কি দরকার ছিল স্বাধীনতা ঘোষনা করে দেশের মানুষকে যুদ্ধে মত ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার?
এটা তো স্বয়ং যিনি ৪৭-৭১ পর্যন্ত ডাকসাইটে রাজনীতি করে গিয়েছেন , আপামর জন সাধারনের চোখেরমনি ছিলেন তিনি তো দিতে সাহস করেন নি শাসকদের চোখে কালারড হয়ে যাবেন বলে !
এখন স্বাধীনতার পক্ষে ঘোষনা দিয়ে , যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে - উনার অনেক দোষ বের হয়ে গেছে । উনি নাকি যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শে !
দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে দেশের প্রধানকে অনেক ডার্টি জব করতে হয় - এটা কে না করেছে?
জিয়াউর রহমান পারতেন যুদ্ধ না করে পাকিস্তানে আরাম আয়েশে জীবন যাপন করতে , যেমনটা এরশাদ করেছে । যুদ্ধ করেও জিয়াকে যেমন কটু কথা শুনতে হয়েছে , যুদ্ধ না করেও জিয়ার মত প্রায় একই সময় পার করেও এরশাদকে কোন কটু কথা শুনতে হয় নি ।
আসলে কথা শুনতে হয় তাদেরই যারা কাজ করে । আর তাদের এই কথা তারাই শোনায় কাজের সময় যাদের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি বা যায় না ।
জিয়া যদি ঐ সময়ে এগিয়ে এসে স্বাধীনতার ঘোষনা দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা না করতেন তাহলে নেতাদের বৃথা আস্ফালনে হতাশাগ্রস্থ জাতির সামনে আর কে বিকল্প ছিল যে তাদেরকে আশার বানী শোনাতো ?
কথা তো অনেকেই বলতে পারে , ক'জন পারে তা করে দেখাতে ?
Zia was the wrong man in the wrong place at the right time
আপনার মন্তব্য থেকেও অনেক কিছু বের হয়ে এলো, জানতে পারলাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন